রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার মাধ্যমে রোজা পালন করা সম্ভব, তবে এর জন্য কিছু নির্দেশনা মেনে চলা উচিত।
ইফতারের জন্য ডায়েট পরিকল্পনা:
রমজানে ইফতার শুধুমাত্র রোজা ভাঙার সময় নয়, বরং শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ও বটে। ডায়াবেটিস রোগীদের ইফতারে সঠিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করলে রোজার ক্লান্তি কাটিয়ে ভালভাবে দিনটি শেষ করা যায়। এতে শরীরকে পর্যাপ্ত শক্তি ও উদ্যম প্রদান করা সম্ভব হয়।
খেজুর (১-২টি):
অত্যন্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ ও রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখতে শুরুতেই ১ থেকে ২ টা খেজুর খাওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, যেহেতু খেজুরে সুগার বেশি তাই রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অর্থাৎ সুগারের মাত্রা বেশি থাকলে খেজুর খাওয়া যাবেনা।
পানি বা লো-ক্যালরি শরবত:
-দীর্ঘ সময় খালি থাকার পর, ইফতারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও হালকা খাবার গ্রহণ করলে শরীর পুনরায় শক্তি পায় এবং ডিহাইড্রেশন এড়ানো যায়।
-ডায়াবেটিস রোগীর জন্য চিনি ছাড়া শরবত, ডাবের পানি বা লেবু পানি উপকারী। সাথে ইসবগুল, তোকমা থাকলে ভালো।
প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট:
-অল্প পরিমানে ছোলা, বুট, ডালের স্যুপ, দই, স্টিম বা গ্রিলড মাছ/মুরগি।
-কয়েকটি কাঁচা বাদাম , যেমন: কাঠবাদাম/আখরোট/কাজু/ পেস্তা বা মিক্সড বাদাম ইফতারের জন্য খুবই স্বাস্থ্যকর।
ফল :
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের এমন ফল খাওয়া উচিত যা রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে বাড়িয়ে না দেয় এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) কম। কিছু স্বাস্থ্যকর বিকল্প হলো:
আপেল – ফাইবার বেশি, GI কম
নাশপাতি – রক্তে শর্করা ধীরে বাড়ায়
বেরি ফল (স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি, রাস্পবেরি) – অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ, কম GI
কমলা, মাল্টা – ভিটামিন C বেশি, GI মাঝারি
আঙুর (সীমিত পরিমাণে) – অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি, তবে বেশি না খাওয়াই ভালো
পেঁপে – ভিটামিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ, হজমে সহায়ক
জাম/কালোজাম – রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
যা এড়িয়ে চলা ভালো
কলা বেশি পরিমাণে গ্রহণ – GI তুলনামূলক বেশি
আম (বিশেষ করে বেশি মিষ্টি জাতের)
আনারস – উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্স
লিচু –প্রাকৃতিক চিনি অনেক বেশি থাকায় ও বদহজম হওয়ার আশঙ্কা থাকায় সারাদিন অভুক্ত থাকার পর প্রথম খাবারে লিচু না রাখাই ভালো ।
অতিরিক্ত পরামর্শ: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইফতার ও সেহরিতে ফল খাওয়ার সময় পরিমাণের দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।
শাক-সবজি ও স্যুপ:
হজমে সহায়ক, পেট ভরিয়ে রাখে এবং শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক । শাকের বা সবজির বা মিক্সড শাকসবজির স্যুপ রাখতে পারেন।
ইফতারে এড়িয়ে চলুন:
ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার
বেশি মিষ্টিজাতীয় খাবার ও
অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট।
রাতের খাবার:
রমজানে ইফতারের পর রাতের খাবার (ডিনার) গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে এবং সেহরির আগে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য রাতের খাবার হতে হবে পুষ্টিকর, পরিমিত এবং কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) সম্পন্ন খাবারযুক্ত।
রাতের খাবারের সঠিক পরিকল্পনা
পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট
গ্রিলড/সেদ্ধ মাছ বা মুরগির মাংস (অতিরিক্ত তেল ছাড়া ও পরিমান মত
ডাল বা মসুর ডালের স্যুপ
টফু বা সয়া প্রোটিন ( সম্ভব হলে মাঝে মাঝে)
জলপাই তেল বা অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তেল অল্প পরিমাণে রান্নায় ব্যবহার করুন
কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট:
লাল চালের ভাত বা অল্প পরিমাণ সাদা ভাত, অথবা
লাল আটার রুটি বা মাল্টিগ্রেইন রুটি
অথবা,
ওটমিল বা কুইনোয়া
শাকসবজি ও ফাইবার:
শাকসবজি বেশি পরিমাণে রাখুন (পেঁপে , চালকুমড়া, ঝিঙা , চিচিঙ্গা ,লাউ, ব্রকলি, গাজর, টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি মৌসুমি সবজি বেছে নিতে পারেন সবজি তালিকায় )
সবজি সেদ্ধ করুন কম তেলে
দুধ বা দুধ জাতীয়: ইফতারের পরে অনেকেই রাতের খাবার একদম খেতে পারেনা। সেক্ষেত্রে এক কাপ দুধ খাওয়া উত্তম
রাতের খাবারে এড়িয়ে চলতে হবে:
বেশি পরিমাণ ভাত ও সাদা চালের ভাত
নরম পানীয়
ডেজার্ট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার
অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার (পরোটা, পুরি, পিয়াজু , বেগুনি, সমোसा, ইত্যাদি
প্রসেসড ফুড (ফাস্টফুড, ইনস্ট্যান্ট নুডলস)
পরামর্শ:
রাতের খাবার ও ইফতারের মাঝে ১.৫-২ ঘণ্টার বিরতি দিন
ধীরে ধীরে খাওয়ার অভ্যাস করুন
রাতের খাবারের পর ১৫-২০মিনিট হালকা হাঁটাহাঁটি করুন
ওজনাধিক্য বা স্থূলতা থাকলে রাতের খাবারে কার্বোহাইড্রেট না রাখাই উত্তম
সেহরি:
ডায়াবেটিস রোগীর সেহরীর খাবার এমন হওয়া উচিত যাতে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ করে না বাড়ে এবং দীর্ঘ সময় শক্তি দেয়। এতে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত খাবার, উচ্চ ফাইবার, প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকা দরকার।
জটিল কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করুন: বাদামি চালের ভাত, বা লাল আটার রুটি, বা ওটস ইত্যাদি ধীরে হজম হয় এবং দীর্ঘক্ষণ শক্তি প্রদান করে।
প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খান: ডাল, মাছ, মুরগির মাংস ইত্যাদি রক্তে শর্করার স্তর স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।
শাকসবজি দই: শাকসবজি ফাইবার সরবরাহ করে এবং সারাদিনের পুষ্টি এবং টক দই পরিপাকতন্ত্রের জন্য উপকারী।
অতিরিক্ত পরামর্শ
- নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরিমাপ করুন: সেহরি আগে, দিনের বেলায় এবং ইফতারের ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও হালকা ব্যায়াম করুন: শরীর সুস্থ রাখতে হালকা ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ নিন: রোজা রাখার আগে ওষুধের ডোজ ও সময়সূচি সম্পর্কে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। ডায়াবেটিস এর সাথে যদি অন্য কোন রোগ থাকে, যেমন:/কিডনি/হার্ট, হাইপারটেনশন/লিভার/ওজনাধিক্য/থাইরয়েড ইত্যাদি রোগ থাকলে স্ব স্ব ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে ঔষধ কি চলবে ঠিক করে নেওয়ার পাশাপাশি
সঠিক পথ্য নির্বাচন এর জন্য অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদ এর পরামর্শ নিন এবং ডায়েট চার্ট নিতে পারেন।
সর্বোপরি রোগীর শারীরিক অবস্থা বুঝে পথ্য নির্বাচন করতে হবে।সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনতার মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগীরাও সুস্থভাবে রোজা পালন করতে পারেন ও রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
লেখক : নিউট্রিশনিষ্ট ও ডায়েট কনসালট্যান্ট, মনোয়ারা হসপিটাল ও বিআরবি হসপিটাল।
কমেন্ট