কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) বা হৃদরোগের কারণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা জরুরী।
হার্ট বা হৃৎপিণ্ড মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এর স্পন্দন থেমে যাওয়া মানেই হলো জীবনের গতি শেষ হয়ে যাওয়া। এই অমোঘ সত্য আমরা উপলব্ধি করি; কিন্তু সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা তেমন সচেতন নই। আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে, অসংক্রামক ব্যাধি হিসেবে হৃদরোগের অবস্থান বর্তমানে শীর্ষে। একে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বাংলাদেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি রোগ। তবে জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন, সঠিক ও পরিমিত আহার, ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো, সঠিক কোলেস্টেরল লেভেল বজায়, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশসহ প্রাচ্যের দেশগুলোতেও হৃদরোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। তাই সারা বিশ্বে হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরিতে এই দিবসের ভূমিকা রয়েছে।
হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ৮০ শতাংশ কমানো সম্ভব যদি সেভাবে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কেননা এক দিনে কারো হৃদরোগ হয় না, বরং দীর্ঘদিন ধরে ধমনিতে কোলেস্টেরল জমতে জমতে এই রোগের সৃষ্টি হয়। তাই ধূমপান ও তামাক পরিহার, তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ৩০ মিনিট করে হাঁটা, অ্যালকোহল পরিহার করা, হালকা ব্যায়াম করলে ও কিছুটা কায়িক পরিশ্রম করলে হৃদরোগের আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যাবে।
অনেকে মনে করে, শুধু পুরুষরাই হার্টের রোগে ভোগে। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। পুরুষ ও নারী সবারই হৃদরোগ হতে পারে। এমনকি শিশুদেরও জন্মগত হৃদরোগ, এমনকি ভাল্ভজনিত হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। আবার কিডনি রোগ থেকেও তাদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। ইদানীং ৩০ বছরের কাছাকাছি বয়সী ছেলে-মেয়েরাও হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছে। ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে দেখা যায়, নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৫ বছর বয়স আর নারীর ক্ষেত্রে ৫৫ বছর বয়সের পর হৃদরোগের আশঙ্কা বেশি। নারীর হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রথম জীবনে পুরুষের চেয়ে কম হলেও তা সারা জীবনের জন্য নয়।
তাই হৃদরোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। জীবনধারা পরিবর্তন করেই হার্ট সুস্থ রাখা যায়। এ জন্য সুস্থ হার্টবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাবার ও ধূমপানমুক্ত পরিবেশ ছাড়া একজন ব্যক্তির পক্ষে হৃদরোগের ব্যাপারে ঝুঁকিমুক্ত থাকা কঠিন। হৃদরোগের মূল কারণ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, রক্তে কোলেস্টেরল লেভেল বেশি থাকা, স্থূলতা, বংশগত ইত্যাদি। এখানে শুধু বংশগত কারণ ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে আমাদের নিজেদের সতর্ক থাকার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বংশগত কারণে কারো হৃদরোগ হতে পারে।
হৃদরোগ থেকে বাঁচতে শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম করা উচিত, যাতে শরীর থেকে ঘাম বের হয়। কায়িক পরিশ্রম হার্টের জন্য ভালো। কেউ যখন দ্রুত পায়ে হাঁটবে তখন ফুসফুসে রক্ত চলাচল বাড়বে, হার্ট অক্সিজেন পাবে। এ অক্সিজেনই হার্টের খাবার। মনে রাখতে হবে, মডারেট এক্সারসাইজ সব সময় ভালো, হেভি এক্সারসাইজ কখনোই ভালো না। সব কিছুই মাত্রা রেখে করা উচিত। দিনে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করা ভালো। সাঁতার কাটাও ভালো ব্যায়াম। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ব্যায়াম—শুধু এ দুটি মাধ্যম দিয়ে সাকসেসফুললি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মনে রাখা দরকার, খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাট জাতীয় খাবার কমাতে হবে; কিন্তু প্রোটিন ঠিক রাখতে হবে। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসে ভাজাপোড়া, জাংক ফুড বেশি খাওয়া উচিত নয়।
সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর প্রায় ৮০ শতাংশ কমানো যায়। হার্টবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু জীবনধারা পরিবর্তন করেই হার্ট সুস্থ রাখা যায়। এ জন্য হার্টকে ভালোবাসতে হবে। নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যতথ্য; যেমন—উচ্চ রক্তচাপ, বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই), রক্তে কোলেস্টেরল ও শর্করার মাত্রা সম্পর্কে আগেভাগেই অবগত হতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করলে বলা যায়, হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হাত থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
লেখক : পরিচালক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
ইউটিউব লিঙ্ক
কমেন্ট