বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের পরম চাওয়া প্রতি জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ। যেসব জেলায় মেডিকেল কলেজ নেই সেসব জেলার জনগণ বিশ্বাস করেন, এটা তাদের প্রতি চরম বৈষম্য করা হয়েছে এবং একটি মেডিকেল কলেজ হলেই সে জেলার মানুষ যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।
অশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত কিংবা উচ্চ শিক্ষিত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ একই ধারণায় বিশ্বাসী। কিন্তু মেডিকেল কলেজ ছাড়াও যে মানসম্মত, বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা জনগণের নেই। একটি মেডিকেল কলেজ একাডেমিক প্রতিষ্ঠান। এখানে রোগ নিয়ে গবেষণা হবে, নতুন চিকিৎসক তৈরি হবে, বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে, চিকিৎসার গাইডলাইন তৈরি হবে। এই মূল কাজের পাশাপাশি বাই প্রোডাক্ট হিসেবে রোগী দেখা হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলছে উল্টো রথে। সক্ষমতার বেশি চাপ দিয়ে, বেডের ২-৩ গুণ রোগী দিয়ে জ্যাম করে রাখা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোকে। সিঁড়িতে রোগী, বেডের নিচে রোগী, টয়লেটের সামনে রোগী-রোগী আর স্বজনদের চাপে পা ফেলাই দায়! এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে গিয়ে একাডেমিক পরিবেশ চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। যেখানে রোগী দেখেই কুল পায় না ডাক্তাররা সেখানে ছাত্রদের শেখাবেন তাহলে কী?
উন্নত বিশ্বের সাথে যদি তুলনা করা হয়, আমেরিকায় প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার জন্য গড়ে মেডিকেল কলেজ রয়েছে ০.৬টি। অথচ বাংলাদেশে আছে ৬.৪ টি যা পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের কাছাকাছি (সম্প্রতি আমাদের চেয়ে এগিয়ে) ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ আছে ৩ গুণ! আমাদের কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন হওয়া মালয়েশিয়ার চেয়ে বাংলাৈদেশের মেডিকেল কলেজ প্রায় ৬ গুণ বেশি। এরপরও আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যোজন যোজন পিছিয়ে আছি ওসব দেশগুলোর চেয়ে।
ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জিডিপির সর্বনিম্ন ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতে। ২০২১ সালে ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরে জিডিপির মাত্র ০.৭৪ ভাগ বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে, যেখানে বৈশ্বিক গড় বরাদ্দ ৭.২১ ভাগ। তারপরও যে যৎসামন্য বরাদ্দ রাখা হয় তা দুর্নীতি, অদক্ষতা, স্বজনপ্রীতির কারণে যথাযথভাবে ব্যয় করা সম্ভব হয় না। শুধু ভুরি ভুরি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর ‘তত্ত্ব’ বহুল ব্যবহৃত রাজনৈতিক আই-ওয়াশ ছাড়া কিছুই নয়। অতিরিক্ত মেডিকেল কলেজের ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ মানসম্মত হচ্ছে না, বেকার চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।
বাংলাদেশে যাদের অর্থবিত্ত আছে তাদের হাঁচি-কাশি হলেই উড়ে যান সিংগাপুর, ব্যাংকক প্রভৃতি দেশে। যে মাউন্ট এলিজাবেথে তারা চিকিৎসা নেন, সেই হাসপাতালের কিন্তু কোন মেডিকেল কলেজ নেই। বিশ্বখ্যাত বামরুনগ্রাদ, কিং ফয়সাল, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক হাসপাতালের নেই কোন মেডিকেল কলেজ।
সুতরাং, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে এই দিবাস্বপ্ন থেকে আমজনতার বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি। প্রতি জেলা/বিভাগে মেডিকেল কলেজ নয় বরং দরকার সুপ্রশিক্ষিত জনবল ও যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ ইমার্জেন্সি বিভাগ এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করা। স্বাস্থ্যখাতে এই নামমাত্র বরাদ্ধ আরো বাড়ানো উচিত। নিদেনপক্ষে এই সীমিত বরাদ্দ যাতে মানহীন মেডিকেল কলেজ তৈরি করে অপচয় করা না হয় সে ব্যবস্থা করা উচিত। আমরা চাই, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও রোগী যাতে অন্তত জীবনের অন্তিম শয্যায় একটি হাসপাতাল বেড পায়, ফ্লোরে শুয়ে কাতরাতে না হয়। ডায়ালাইসিস বা ক্যান্সারের ব্যয় টানতে গিয়ে যাতে কোন পরিবারকে সর্বস্বান্ত হতে না হয়। আমরা চাই, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা। আমরা ৫ টাকার টিকেটে ‘মিনিটে ২ জন রোগী দেখা’ চিকিৎসা চাইনা। আমরা চাই মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির মাধ্যমে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সত্যিকার অর্থে নিশ্চিত হোক।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, সিভিল সার্জন কার্যালয়, ফেনী।
কমেন্ট