অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ: অধ্যাপক আমজাদ হোসেন

অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ: অধ্যাপক আমজাদ হোসেন

অস্টিওপরোসিস এমন একটি রোগ যেখানে হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং হাড় ভাঙা র ঝুঁকি বেড়ে যায়। বয়ষ্ক মানুষদের মধ্যে হাড় ভাঙার সবচেয়ে সাধারণ কারণ এটি। তবে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণ করলে এই ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়। সময়মতো সচেতন হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করলে সুস্থ ও কার্যকর জীবনযাপন করা সম্ভব। 

অস্টিওপোরোসিস কেন হয় এবং প্রতিকার, প্রতিরোধই বা কী—এ বিষয়ে বিডিহেলথ২৪ডটকম কে সাক্ষাতকার দিয়েছেন ল্যাবএইড হাসপাতাল লিমিটেডের অর্থপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন

প্রশ্ন : অস্টিওপোরোসিস কথাটার মানে কী? এতে আসলে কী ঘটে?
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : অস্টিওপোরোসিসকে হাড়ের ক্ষয়রোগ বলে থাকে অনেকেই। আসলে কিন্তু রোগটি ডিজেনারেটিভ বা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সম্পর্কিত, ক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ‘অস্টিও’ শব্দটির অর্থ হাড়, ‘পরোসিস’ অর্থ পোরস বা ছিদ্র। যাদের অস্টিওপোরোসিস দেখা দেয়, তাদের হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। কারণ রোগটির ফলে হাড়ের অভ্যন্তরে তৈরি হয় ছোট ছোট গর্ত। হাড় কতটা মজবুত, তা নির্ভর করে ঘনত্বের ওপর। হাড়কে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে ফেলে গর্তগুলো।

প্রশ্ন : কোন বয়সে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে? কারা ঝুঁকিতে থাকে বেশী?
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : সাধারণত বয়স ৫০ বছর পার হওয়ার পর নারী ও পুরুষ উভয়েরই অস্টিওপোরোসিস দেখা দিতে শুরু করে। তবে নারীরা ঝুঁকিতে থাকেন বেশি, কারণ মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে তাঁদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব।
 
প্রশ্ন : হাড়ের ওপর এর কী প্রভাব পরে? 
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : হাড়ের দুটি অংশ, কমপ্যাক্ট বোন এবং স্পঞ্জি বা ট্রেবাকুলার বোনের সমন্বয়ে সেটি গঠিত হয়। অস্টিওপোরোসিস হলে হাড়ের ওপরের আবরণ বা কমপ্যাক্ট বোনের পুরুত্ব্ব কমে যায়, পাশাপাশি স্পঞ্জি অংশটির ছিদ্র বেড়ে যায়, ফলে কমে যায় ঘনত্ব। দুটির প্রভাবে হাড় বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে, বাড়ে ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি।
 
প্রশ্ন : অস্টিওপোরোসিস এর কারণ কী?
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : সুস্থ দেহে প্রতিনিয়ত হাড়ের কোষগুলো পুরনো ও ক্ষতিগ্রস্ত হাড় সরিয়ে নতুন করে হাড় তৈরি করে। অস্টিওপোরোসিসের মূল কারণ, হাড়ের গঠন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। সেটির কয়েকটি প্রধান কারণ আছে। এগুলো হলো—

বয়স: প্রত্যেক মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। তখনই অস্টিওপোরোসিস রোগের শুরু।

হরমোনগত পরিবর্তন: মেনোপজ পার হওয়ার পর নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কমে যায়। তখন অস্টিওপোরোসিসের লক্ষণ নারীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি দেখা যায়।

বংশগত: যাদের বংশে অস্টিওপোরোসিস রোগের ইতিহাস আছে, তাদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি।

খাদ্যাভ্যাস: ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার কম খেলে দেখা দিতে পারে হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। এর ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যায়।

জীবনযাপন: ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান, অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন করলেও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়ে।

প্রশ্ন : এই রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে যদি বলতেন।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : এই রোগের লক্ষণগুলো শুরুতে চিহ্নিত করা কঠিন। কেননা প্রথমে রোগটির তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না, সম্ভাব্য যেসব উপসর্গ দেখা যেতে পারে, সেসব খুবই সাধারণ যেমন—শরীরে ব্যথা বা চাপের অনুভূতি। রোগীদের মনে সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। তবে রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে লক্ষণগুলোও প্রকট হয়। 
তবে রোগটি গুরুতর আকার ধারণ করলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে, যেমন—

♦ ঘাড়, কোমর ও মেরুদণ্ডে প্রতিনিয়ত ব্যথা অনুভূত হয়, যা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় পরিণত হতে পারে।
♦ পেশির ব্যথা বা পেশিতে দুর্বলতা।
♦ মেরুদণ্ডের হাড় সংকুচিত হয়ে উচ্চতা কমে যাওয়া বা কুঁজো হয়ে যাওয়া।
♦ পাঁজরের হাড় নিচের দিকে ঝুলে পড়া।
♦ ছোটখাটো আঘাতে হাড় ভেঙে যাওয়া।

প্রশ্ন : বেশী ঝুঁকিতে কারা?
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : যাদের হাড় ভাঙার ইতিহাস আছে, যারা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় অথবা খিঁচুনির ওষুধ সেবন করেছেন-তাদের এ রোগের ঝুঁকি সমবয়সীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। এ ছাড়াও যাদের বাতজনিত রোগ, থাইরয়েড ও প্রজনন গ্রন্থির সমস্যা, খাদ্যনালি থেকে পুষ্টি ও ভিটামিন শোষণে সমস্যা আছে—তাদের অপরিণত বয়সেও অস্টিওপোরোসিস দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন : অস্টিওপোরোসিসের আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে চাই। 
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : অস্টিওপোরোসিস শনাক্ত হলে ভয়ের কারণ নেই। সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সে জন্য যা প্রয়োজন—

♦ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ।
♦ বায়োফসফোনেটস জাতীয় ওষুধ ব্যবহার, যা হাড়ের ক্ষয় কমায়।
♦ নারীদের জন্য হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি।
♦ শারীরিক থেরাপি, ব্যায়াম ইত্যাদি।
 
প্রশ্ন : অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে কী করণীয়?
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : অস্টিওপোরোসিস চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। এজন্য সচেতনতা এবং সঠিক জীবনযাপন অত্যন্ত জরুরি। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হলো—

সুষম খাবার গ্রহণ: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যেমন—দুধ, দই, পনির, ছোট মাছ ইত্যাদির পাশাপাশি ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।

ভিটামিন ডি গ্রহণ : ভিটামিন-ডি’র অভাব পূরণে প্রতিদিন কিছু সময় সূর্যের আলোতে থাকুন। এ ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম ও ডিমের কুসুম ইত্যাদি খেতে হবে। ভিটামিন ডি’র ঘাটতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন।

নিয়মিত ব্যায়াম: নিয়মিত কায়িক শ্রমসহ কিছু শরীরচর্চা, যেমন—দ্রুত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালনা ইত্যাদি নিয়মিত করা উচিত। কসরতগুলো সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ দিন ৩০ মিনিট ধরে করুন।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন, এসব হাড় ক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: যারা ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে পড়ে, তাদের নিয়মিত হাড়ের ঘনত্ব পরীক্ষা করা উচিত জানার জন্য যে তারা অস্টিওপোরোসিসে ভুগছে কি না।

ওষুধ ও পরামর্শ: প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। হাড় ক্ষয় রোধে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধও কার্যকর।

প্রশ্ন : মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
অধ্যাপক আমজাদ হোসেন : বিডিহেলথ২৪ডটকম কেও অশেষ ধন্যবাদ।

 

অধ্যাপক আমজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ : 

 

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায় পূর্ববর্তী

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

ক্যান্সার : প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় পরবর্তী

ক্যান্সার : প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়

কমেন্ট