সারা বিশ্বেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্যান্সার রোগী। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। প্রাণঘাতী এই রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায় জানাচ্ছেন অধ্যাপক ডা. পারভীন শাহিদা আখতার
ক্যান্সার একটি জটিল ও গুরুতর রোগ, যেখানে দেহের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হয়ে অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। সাধারণত শরীরের কোষগুলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বিভাজিত ও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই নিয়ম ভেঙে যায়। এখন পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
এর মূল কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা না পড়া এবং সঠিক চিকিৎসা না করা।
কারণ
ক্যান্সারের এমন কিছু ফ্যাক্টর বা কারণ রয়েছে, যেগুলো শরীরের কোষের ডিএনএতে পরিবর্তন ঘটিয়ে কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিভাজনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। এতে কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। কিছু রোগীর ক্যান্সার বংশগত। পরিবারে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে অন্যদেরও ঝুঁকি থাকে। তবে ক্যান্সারের বেশির ভাগ কারণই পরিবেশগত এবং জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে আছে—
ধূমপান ও তামাক সেবন : ফুসফুস, মুখ, গলা ও পাকস্থলীর ক্যান্সার হতে পারে ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য সেবনে ।
অ্যালকোহল গ্রহণ : অতিমাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ করলে লিভার, স্তন, গলা ইত্যাদি ক্যান্সারাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : চর্বিযুক্ত ও প্রসেসড খাবার বেশি খেলে কোলন ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
পরিবেশ দূষণ : বায়ু ও পানিদূষণ হতে পারে ক্যান্সারের কারণ।
রেডিয়েশন : সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের ক্যান্সার ঘটাতে পারে। এক্স-রে বা তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অ্যাসবেস্টস, বেনজিন ও কীটনাশকও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
ভাইরাস : জরায়ু ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের কারণেও লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
ব্যাকটেরিয়া : হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি পাকস্থলীর ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা : কিছু হরমোন স্তন, জরায়ু বা প্রস্টেট ক্যান্সার বাড়ায়।
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ : শরীরে কোনো স্থায়ী প্রদাহ থাকলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
আচরণগত এবং অন্যান্য কারণ : স্থূলতার কারণে স্তন, কোলন ও কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
ওষুধ বা স্টেরয়েড : কিছু ওষুধও শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
লক্ষণ
ক্যান্সারের লক্ষণ নির্ভর করে এটি শরীরের কোন অংশে হয়েছে এবং কোন পর্যায়ে রয়েছে। তবে কিছু প্রাথমিক লক্ষণ আছে, যা ক্যান্সারের ইঙ্গিত দিতে পারে। এসব দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যেমন—
♦ দেহের কোনো স্থানে গুটি বা ফোলাভাব, বিশেষত এটি যদি ধীরে ধীরে বড় হয়
♦ দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ক্ষত না শুকানো
♦ সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ওজন দ্রুত কমে যাওয়া
♦ অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা
♦ ক্ষুধামান্দ্য বা খাবারে অনীহা
♦ দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ব্যথা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশির সঙ্গে রক্ত আসা
♦ প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ও রক্ত আসা
♦ কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া বা মলের রঙে পরিবর্তন
♦ ত্বকে অস্বাভাবিক দাগ, কালচে রং বা তিলের আকৃতি এবং রং বদল
♦ দীর্ঘস্থায়ী জ্বর বা প্রদাহ দেখা দেওয়া
♦ হাড়ের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হাড় বা শরীরের অন্যান্য অংশে ব্যথা
চিকিৎসা
রোগের ধরন, অবস্থান, পর্যায় (স্টেজ) এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা ও বয়সের ওপর নির্ভর করে ক্যান্সারের চিকিৎসা। উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতির সমন্বিত চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
সার্জারি : ক্যান্সারের টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। এটি প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।
কেমোথেরাপি : বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করে ক্যান্সারের কোষ ধ্বংস করাকে বলা হয় কেমোথেরাপি। এর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারও ধ্বংস করা যায়। তবে এতে বমি, ক্লান্তি, চুল পড়া, ওজন কমে যাওয়ার মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
রেডিওথেরাপি : শক্তিশালী রেডিয়েশন, যেমন—এক্স-রে বা গামা রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করাকে বলে রেডিওথেরাপি। এটি টিউমার ছোট করতে বা অস্ত্রোপচারের আগে বা পরে ব্যবহার করা হয়। এরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ত্বকের সমস্যা, ক্লান্তি, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
ইমিউনোথেরাপি : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযুক্ত করা হয়। উদাহরণ—মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বা চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর ব্যবহার।
টার্গেটেড থেরাপি : ক্যান্সার কোষের নির্দিষ্ট জিন, প্রোটিন বা টিস্যুকে লক্ষ্য করে চিকিৎসা। এটি সাধারণত বায়োপসি বা জিনেটিক টেস্টের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলক কম।
হরমোন থেরাপি : কিছু ক্যান্সার, যেমন—স্তন বা প্রস্টেট ক্যান্সার হরমোনের ওপর নির্ভরশীল। হরমোন ব্লকিং ওষুধ দিয়ে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করা হয়।
স্টেম সেল থেরাপি : রক্তের ক্যান্সার, যেমন—লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। নতুন স্টেম সেল প্রতিস্থাপন করে রক্তকোষ পুনরুদ্ধার করা হয়।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার : ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব না হলে রোগীর আরাম এবং জীবনমান উন্নত করতে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এতে ব্যথা, ক্লান্তি ও মানসিক চাপ কমানোর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
চিকিৎসা শুরুর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বায়োপসি, সিটি স্ক্যানের মতো বিভিন্ন পরীক্ষা করানো হয়। চিকিৎসা পদ্ধতি ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সবার অবগত থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, ক্যান্সার চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। ধৈর্য হারানো যাবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসা আরো কার্যকর হয়। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস পরিহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, মেডিক্যাল অনকোলজি জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
সভাপতি, মেডিক্যাল অনকোলজি সোসাইটি ইন বাংলাদেশ।
কমেন্ট